শুরুর গল্প

কিভাবে শুরু হলো Humanix BD

চুপচাপ কোনো নিম্ন আয়ের ঘিঞ্জি, বস্তি বা জনবহুল এলাকার কোনো টং দোকানে কিংবা একটু নির্জন স্থানে বসে মানুষ দেখা, মানুষের ব্যস্ততা, কর্মচঞ্চলতা, মানুষের মুখের সুখ-দুঃখের ছবি দেখা, এসব যেন আমার একধরনের নেশা। প্রতিদিন রুটিন করে কয়েক ঘণ্টা এই কাজ না করলে আমি শান্তি পাই না, মনে হয় দিনটা অপূর্ণ থেকে গেল।

প্রতিদিনের মতোই আমি বসেছিলাম ঢাকার অদূরে এক রেলস্টেশনের রেললাইনের পাশের এক টং দোকানে। আশেপাশে দেখছি নানা মতের, নানা পেশার মানুষ তাদের কর্মকান্ড সূর্যের আলো প্রায় নিভে এসেছে, আমিও প্রস্তুতি নিচ্ছি দোকানের বিল মিটিয়ে ঢাকা মুখী যে ট্রেন থামবে, তাতে উঠে পড়ববো।

ঠিক তখনই আমার চোখ গেল দোকান থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোকের দিকে। গায়ে টি-শার্ট, পড়নে জিন্স, পায়ে স্যান্ডেল, চোখে চশমা—চেহারায় স্পষ্ট মধ্যবিত্তের ছাপ। কিন্তু উনি যেন উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটাহাঁটি করছেন। মাঝে মাঝে ঘাসের ওপর বসে পড়ছেন, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছেন, দুই হাতে চুল টানাটানি করছেন, আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকছেন। অনেকক্ষণ ধরে একই দৃশ্য। কৌতূহল জাগল আমার ভেতর।

এরই মধ্যে একটি আন্তঃনগর ট্রেন না থেমে শোঁ শোঁ করে পাশ দিয়ে চলে গেল। এবার দেখলাম, উনি প্যান্টের পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন, তারপর আবার পকেটে রেখে ট্রেনলাইনটার মাঝখানে গিয়ে বসে পড়লেন।

সাধারণ চোখে দেখলে হয়তো ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, কিন্তু আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। আমি দোকান থেকে বিল মিটিয়ে হাতে একটা সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে তার দিকে এগোলাম। সাধারণত আমি যেচে কারও সঙ্গে কথা বলি না, কিন্তু এবার কিছু একটা মনে হলো। একটু দূরত্ব রেখে বসলাম। প্যাকেট থেকে একটা শলাকা বের করে এগিয়ে দিলাম, বললাম “সিগারেট খান, নেন?”

উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর একটা নিলেন, আগুন জ্বালালেন। বুঝলাম, আলাপ করা যাবে। কিছুটা সময় দিয়ে শুরু করলাম “ভাই, আপনার নাম?”

ধীরে ধীরে আলাপ জমে উঠল। উনি আসতে আসতে আমার প্রশ্নের উত্তরে ঝাঁপি খুলতে শুরু করলেন। আমরা এরপর রেললাইন থেকে উঠে একটু দূরে নির্জন স্থানে বসলাম। ঘড়িতে তখন রাত ৯টা ছুঁই ছুঁই। আমার ঢাকায় ফিরতে হবে।

আমি বললাম, “ভাই, আজ বাড়ি যান। কাল বিকেলে আমি আবার আসব, আমরা একসাথে চা-সিগারেট খাব। তারপর আপনার যা ইচ্ছে, করবেন। শুধু কথা দিন, কাল সন্ধ্যায় আপনি এখানে থাকবেন।”

উনি অবাক হয়ে তাকালেন, বললেন, “কেন ভাই?” আমি বললাম, “কারণটা আমারও জানা নেই, তবে ধরে নিন এটা আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা।”

উনি একটু হেসে বললেন, “A dead man can’t fulfill someone’s wish.” আমি হেসে উত্তর দিলাম, “But he can walk.”

উনি অবশেষে কথা দিলেন, তিনি আগামীকাল আসবেন। আমরা কেউ কারও ফোন নম্বর নেইনি, শুধু দুজন দুদিকে হেঁটে চলে গেলাম। ২০-২৫ মিনিট পর আমি একটি লোকাল ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেন চলার সময় মাথায় শুধু একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল—“আমাদের জীবনে এমন কত মানুষ আছে, যারা ভয়, লজ্জা বা সমাজের চোখে ইজ্জত হারানোর ভয়ে তাদের কষ্ট কাউকে বলতে পারে না, তাঁদের সমস্যা শেয়ার করতে পারে না, শেয়ার করলে কাছের মানুষ আরও দূরে চলে যায়, সমাজে ইজ্জত চলে যায়, আর মধ্যবিত্তের ইজ্জত গেলে তাঁদের আর কিছু থাকে না।”

ঢাকায় ফিরে সারারাত ঘুম হয়নি। আমি সাধারণত আবেগপ্রবণ মানুষ নই, কিন্তু সেদিন চোখের পানি থামাতে পারিনি, ব্রেইন কথা শুনেনি, তার জন্য কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই, নিজের অক্ষমতার কষ্টে ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু এও চিন্তা করলাম আমি একা কিছু করতে পারব না, কিন্তু হয়তো এই দেশে ২০ কোটি মানুষের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন, যারা একসাথে চাইলে পারবে।

এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় Humanix BD এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে মানুষ তাদের কষ্ট, সমস্যা, বিপদ সব কিছু নির্ভয়ে বলতে পারে, সাহায্য চাইতে পারে, আর অন্যরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা, মানবিকতা এবং জবাবদিহিতার মাধ্যমে।

“Humanix BD শুধু একটি উদ্যোগ নয় — এটি মানুষের জন্য, মানুষের তৈরি এক মানবিক সেতুবন্ধন।”

— Miftaul Hasan
Founder, Humanix BD

Scroll to Top